আজ ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিন
এই শহরে ভাষাচার্য একদিন
তমাল সাহা
গোধূলির গেরুয়া রঙে বিষণ্ণ এই আকাশে সূর্য অস্তাচলগামী, রাত্রির গভীর অন্ধকারের ভেতর এক এক করে নক্ষত্রগুলি ফুটে ওঠে। তখন তমুর মনে পড়ে যায় সেই সব বিগত দিনের স্মৃতি। ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে তমু। তমুর চোখের সামনে ভেসে ওঠে বৈদগ্ধ্যে সমৃদ্ধ মনীষাদের মুখ। রাজনৈতিক নয়, রাজনীতির পরিমণ্ডল
ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হচ্ছে এই সাংস্কৃতিক পরিবেশ। ভাগীরথীর তীরে এই আবহাওয়া, এই বাতাবরণে যে সংস্কৃতির চর্চা এবং পরিচর্যা চলত তার বিন্দুমাত্র চিহ্ন আর দেখে না তমু এই যাপিত জীবনে। এই ভূখণ্ডে একদিন ছিল সাহিত্য,নাটক, ক্রীড়া-সংস্কৃতির বহমান প্রবাহ।সেইসব মুখগুলি এখন মনে পড়ে যারা কাঁচরাপাড়ার জনজীবনে এক উল্লেখযোগ্য ইতিহাস রচনা করেছিলেন।
১৯৬৩ সাল কাঁচরাপাড়ার সাহিত্য আন্দোলন চিরজীবী হয়ে থাকবে। জেলা বাংলা সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল শ্রমিষ্ঠ জীবনে সমাকীর্ণ এই রেলওয়ে বেল ইনস্টিটিউটে।
২৩ এবং ২৪ মার্চ ১৯৬৩ দুইদিন ব্যাপী সেই সাহিত্য সম্মেলন, জেলার জীবনে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। এই সাহিত্য সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে এই শহরের মাটিতে পা রেখেছিলেন ডঃ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়। ২৪ মার্চ তিনি বিশেষ ভাষণ দিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্য, বাংলা সাহিত্যের প্রসার, বাংলা সাহিত্যের গুরুত্ব– সে এক অপূর্ব ঋদ্ধ আলোচনা।
ছবিঃ শিক্ষামন্ত্রী হরেন্দ্রনাথ চৌধুরী ও লেডি রাণু মুখার্জি
এই প্রসঙ্গে আর একটি ঘটনার ছায়াপাত ঘটে গেল,তমুর হৃদয়ের ভেতর। দু’দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠানটি যার সাহচর্য এবং সান্নিধ্যে তমু প্রত্যক্ষ করেছিল তখন তমুর কৈশোরের ছেলেবেলা,তিনি কাঁচরাপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক অমিয়ভূষণ সরকার। এই ২৩ নভেম্বর ২০২১ মঙ্গলবার তিনি প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর স্নেহধন্য তমু। তাঁর কারণেই এইসব প্রজ্ঞাবান মানুষের মুখ তমু দেখতে পেয়েছে।
এই সাহিত্য সম্মেলন উপলক্ষে সঞ্জীব কুমার বসুর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল সাহিত্য সম্মেলন সংখ্যা ১৩৭৫। পত্রিকাটির নাম ছিল ‘সংস্কৃতি’। সেই দ্বিতীয় সংখ্যায় তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় লিখেছিলেন- সাহিত্যের নবরাগিণী।
তমুদের শিক্ষক অমিয়ভূষণ সরকার লিখেছিলেন– ২৪ পরগণা জেলার মনীষী। অশোক কৃষ্ণ দত্ত লিখেছিলেন– ২৪ পরগণা জেলার পত্তন ও বৈশিষ্ট্য। দক্ষিণারঞ্জন বসু লিখেছিলেন– আত্মচরিতে ২৪ পরগণার দুই মনীষী। আর সম্পাদক সঞ্জীব কুমার বসু লিখেছিলেন–২৪ পরগণার সাময়িক পত্রিকা।
ছবিঃ ভাষণরত ভাষাচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়
এই বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনে মূল আয়োজক সঞ্জীব কুমার বসু এবং আঞ্চলিকভাবে তার পূর্ণ সহযোগী ছিলেন তমুদের বাংলার মাস্টারমশাই অমিয়ভূষণ সরকার।
উল্লেখযোগ্য এই অনুষ্ঠানে তমু দেখেছে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী রায় হরেন্দ্র কুমার চৌধুরী, রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্যা লেডি রাণু মুখার্জী,এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়,
সাহিত্যিক দক্ষিণারঞ্জন বসু প্রমুখের মুখ। তাঁদের ভাষণ শুনেছে। এ তমুর জীবনে এক স্মরণীয় ঐতিহাসিক ঘটনা।
এই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এত বিশাল মাপের হয়েছিল যা কাঁচরাপাড়ার বর্তমান পরিস্থিতিতে ভাবাই যায় না।
২৩ মার্চ এই সম্মেলনের উদ্বোধন করেন শিক্ষামন্ত্রী হরেন্দ্র নাথ চৌধুরী এবং অধিবেশন উপলক্ষে প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন লেডি রাণু মুখার্জী। এই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়।
সেই অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে কাঁচরাপাড়ায় বসে গিয়েছিল চাঁদের হাট। কে না হাজির ছিলেন এই অনুষ্ঠানে! হাজির ছিলেন দক্ষিণারঞ্জন বসু, রম্যাণি বীক্ষ্য খ্যাত এবং রবীন্দ্র পুরস্কারে সম্মানিত কাঁচরাপাড়া অফিসার্স কলোনিতে বাসরত রেলওয়ে ওয়েল ফেয়ার অফিসার সুবোধ চক্রবর্তী, অশোক কৃষ্ণ দত্ত, ডঃ দীনেশ চন্দ্র তপাদার, প্রমোদ বিকাশ ডট্টাচার্য, হিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় ও ফণীন্দ্র নাথ মুখোপাধ্যায়।
উল্লেখযোগ্যভাবে উপস্থিত ছিলেন ভাষাবিদ ডঃ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় এবং তিনি বিশেষ ভাষণ দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর পাণ্ডিত্যকে স্বীকৃতি প্রদান করে ভাষাচার্য শিরোপায় ভূষিত করেন।
এই অনুষ্ঠানে মঞ্চস্থ হয়েছিল বিশিষ্ট অভিনেতা সুশীল সরখেলের পরিচালনায় আনন্দমঠ নাটক। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নাট্যশিল্পী অহীন্দ্র চৌধুরী।
কাঁচরাপাড়ার বুকে শিলাপাথরে খোদিত হয়ে রয়েছে এই ইতিহাস।
একদিন প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান হয়ে যাবে!