শরৎ শেষ হয়ে হেমন্ত বেলা চলে এলো। হিম পড়ছে। আসছে অমাবস্যার প্রহর।
পুজোর মরশুম। ফুলের খেলা। কত সব ফুলওয়ালি। এসো তাদের সঙ্গে কথা বলি…

এই ফুলওয়ালির নাম বলবো না
তমাল সাহা

তারপর থেকে রোজই দেখা হতে থাকলো। একটা ইস্টিশান ও একটা ট্রেন এভাবেই কোন ঘটনা ঘটিয়ে দেয়। পরিচয় হয়ে গেলে বাঁধনের গিট শক্ত হতে থাকে।

সুন্দর ঝকঝকে কালোপানা নারীটি। ট্রেন থেকে নেমে যখন আমাকে মাথায় ফুলের গাঁটরি উঠিয়ে দিতে বলে তখন সকালে তার শরীর জুড়ে এতো সাজগোজ আমাকে ভাবিয়ে তোলে।

সুন্দর করে বেনুনি বাঁধা চুল, কপালে গাঢ় লাল টিপ, পরনে গামছা শাড়ি, হাতে শাঁখা, লাল পলা।
নারীটি মদনপুর থেকে ফুল নিয়ে আসে। স্বামী রোজে টোটো চালায়। দুটি ছেলে রূপম আর রাহুল, সেভেনে ও নাইনে পড়ে।

দোকান সাজিয়ে বসে গান্ধীমোড়ে। ফুটপাতের ধার ঘেঁষে নীল বড় একটা পলিথিন সিট পাতে। নানা রকম ঝুরো ফুল তো আছেই,আছে দোপাটি গাঁদা নীলকন্ঠ আকন্দ জবা ফুলের মালা, রজনীগন্ধার স্টিক– সবই আছে তার দোকানে। তার সঙ্গেই থাকে সাদা মোটা সুতো ও বড় লম্বা একটা ছুঁচ। এ দিয়ে সে রজনীগন্ধার মালা গেঁথে চলে।

ফুল বেচো কেন, সবজিও তো বেচতে পারো? সে আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকায়।

জানেন তো এই ব্যবসার কোনো মার নেই। এই ব্যবসা কেউ কোনোদিনও খতম করতে পারবে না।
খতম শব্দটি শুনে আমি আঁতকে উঠি।

এখন ধর্মের জোর বেশি। রবি থেকে শনি রোজই হিন্দুদের দেবদেবীর পুজো হয়। রোজই ফুল লাগে। আর এগলি ওগলিতে, বড় রাস্তায় মোড়ে, রিক্সাস্ট্যান্ডে, পাড়ায় পাড়ায় একটা না একটা মন্দির আছেই। এখন তো হনুমানজিরও মন্দির ঘটা করে বেড়ে গেছে। যত মন্দির হয় আমার তো ততই লাভ।

বিয়ে তো আছেই। রোজই তো জন্মদিন আর মৃত্যুদিন। সেটা ঠেকাবে কে? ফুল লাগবেই। এই ব্যবসা কোনদিনও কোতল করা যাবে না। নেতারা আসবে, মিটিং হবে। তাকে বরণ করতে হবে। ফুলের মালা, ফুলের বুকে লাগবে।

আমি বলি, বুকে না গো মেয়ে, বোকে!

তাছাড়া দুর্গাপূজা আসছে তারপর লক্ষ্মী, তারপর কালী– একের পর এক পুজো এখন পুজোর মরশুম। ফুল লাগবেই। তাই এই ব্যবসাটা ধরেছি।

তুমি আসলে থাকো কোথায়?

ওই মদনপুর স্টেশনে নেমে ট্রেকারে করে যেতে হয় মল্লারপুর সেখানে।

তা ফেরো কখন?

এখানে সন্ধ্যে সাতটা পর্যন্ত থাকি। তারপর সাতটা পঁচিশের ট্রেনে ফিরে যাই।

রোজ হয় কত?

তা মিথ্যে বলবো না। গড়ে তিন- চারশো টাকা, কোনো দিন ৫০০ টাকাও আয় হয়। মানুষ আমার হাত থেকে ফুল কেনে, এটাই যথেষ্ট। আমার ভাগ্যি খুব ভালো। তোমার এই পুজো ধর্ম-কর্ম উঠে গেলে আমাকে পেটে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকতে হবে!

বলি, এসব বলছো কেন গো মেয়ে?

হিন্দুদের ধর্ম আর পুজো বন্ধ হয়ে গেলে মানুষ ফুল কিনবে কেন বলুন তো? আমি তো এমনিতে মুসলমান। এটা জানতে পারলে হিন্দুরা আমার থেকে ফুল কিনবে?
মুসলমান মেয়েছেলের হাতের ফুল হিন্দুদের পুজোয় অশুদ্ধ হয়ে যাবে গো!
মুসলমান হলেও আমি হিন্দুদের ভালোবাসি।

এবার সে আমায় তুমি বলে ফেলে। এত্তসব তুমি জানতে চাচ্ছ কেন গো?

তুমি সকালবেলাতেই এতো সাজগোজ করে আসো কেন?

আরো মেয়েরা ফুল বেচতে আসে। আমি কৌশল করে ব্যবসা করি। সকালে উঠে স্নান করে শুদ্ধ হয়ে কপালে লাল টিপ পরি। পরিষ্কার শাড়ি পরে ফুলের গাঁটরি নিয়ে আসি যেন আমাকে হিন্দু মেয়ে বলে মনে হয়। মুসলমান মেয়েরা তো আর শাঁখা সিঁদুর পরে না, আমি পরি। এটাকে তুমি ব্যবসার ছলাকলা বলবেনা?
আমি তাকিয়ে থাকি নারীটির দিকে।

তুমি বলোনা আমার পাপ হবে না তো? হিন্দু দেব-দেবীদের আমি যে ঠকাচ্ছি।

তোমার নাম কি?

আমার নাম চম্পা খাতুন।

চম্পা চামেলি নয়নতারা শেফালি সব নারীরা ফুল হয়ে ফুটে আছে প্রকৃতির বাগানে!