মনে পড়ে সেইসব কালো দিন কালো রাতের কথা।আজ সেই সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মৃত্যুদিন
উত্তাল কাঁচরাপাড়ায় সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়
তমাল সাহা
তিরন্দাজি সময়—
ধাবমান গ্রাম থেকে গ্রামে নকশাল শব্দটি নতুন অভিধায়
ঢুকে যায় বাংলা অভিধানে।
রাইফেলে কার্তুজের মতো
ডিকশিনারিতে মুদ্রিত হয় নক্সালাইট।
সময় এখন ম্যাগজিন বক্স,
বলে যায়–ফাইট ফাইট।
মানুষের জয়গানে নেমে পড়ে অজস্র যুবক
গান্ধীনগরে রাত্রি নামে
রাষ্ট্র তখন অভুক্ত ভক্ষক।
বারাসাত, বেলেঘাটা,বরানগর, কাশীপুর—
পড়ে থাকে অজস্র লাশ।
রাষ্ট্র তিরঙ্গা পতাকা উড়িয়ে বলে
গণতন্ত্র সাবাস! সাবাস!
দ্রোণাচার্য, অমিয়, মুরারি, তিমির, সরোজ
এরা তো কবি!
রক্ত মেখে শুয়ে থাকে ঘাসে
দেয়ালেতে হাসে গান্ধীর ছবি।
সত্তর দশক খুঁজে পায় একটি নাম,সিদ্ধার্থশঙ্কর
দিন নেই রাত নেই চরাচরে হাঁটে ভয়ঙ্কর।
কাঁচরাপাড়ায় বম্বিং চলে,
বুটের দাপট– কেঁপে ওঠে জোনপুর, লিচুবাগান, ডাঙ্গাপাড়া
সন্ত্রাসে অসংখ্য যুবক এপাড়া ছেড়ে ওপাড়া।
হ্যান্ডস আপ, এন্কাউন্টার, কালো গাড়ি
বাতাসকে করে ভারি।
মায়ের বুকে রক্ত হিম
ছেলে ফিরবে কি বাড়ি!
হিরন্বতি তীর, কুরুক্ষেত্র, বিশাল রণভূমি
ঘরে ঘরে গর্জে ওঠে মাতৃক্রোধ।
পুত্রঘাতী রাষ্ট্রীয় জল্লাদ!চাই প্রতিশোধ
এই উত্তাল দশকে, দীর্ঘকায় মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় একবার এসেছিলেন বক্তব্য রাখতে কাঁচরাপাড়ার সার্কাস ময়দানে। সঙ্গে সহধর্মিণী মায়া রায়। সার্কাস ময়দানের উত্তরদিকে পেছন রেখে দক্ষিণে মুখ করে মঞ্চ বাঁধা হয়েছিল। তিনি বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তথ্য দিয়ে। পাশে উপবিষ্টা মায়া রায়। সেইসব তথ্যপত্র একটার পর একটা তুলে দিচ্ছিলেন তার হাতে। সিদ্ধার্থ শঙ্করের রাজত্বকালকে বলা হত ‘সিদ্ধার্থ জমানা’। তিনি আরও একবার এসেছিলেন ১৩ নভেম্বর ১৯৭২। কাঁচরাপাড়া কলেজের শিলান্যাহ করেছিলেন তিনি।
আজ নিশ্চয়ই কাঁচরাপাড়ার অসংখ্য যুবক যারা দলবাজি থেকে অবসর নিয়েছেন অথবা প্রবীণ হয়ে রাজনীতি করছেন তাদের কি মনে পড়ছে সেইসব দিন? জোনপুর, লিচুবাগান কবরস্থান অঞ্চলে কত বিপ্লবী যুবক হারিয়ে গিয়েছেন। কবরস্থান মাঠে বসেছে কোর্ট মার্শাল। কত যুবক গ্রেপ্তার হয়ে হাজতবাসে কাটিয়েছেন। কত যুবক দীর্ঘকাল ছিলেন অজ্ঞাতবাসে সিদ্ধার্থ শঙ্করের জমানায়।
থার্ড ডিগ্রি বস্তুটি যে কী তা আমরা প্রথম জানতে পারি সিদ্ধার্থ জমানায়। গুহ্যদ্বারে, নারী যৌনাঙ্গে রুল বা শিকের অনুপ্রবেশ, কম্বল ধোলাই, বৈদ্যুতিক শক, আঙুলে পিন ফোটানো, গরম বাল্বে চুমু,
উলঙ্গ করে হিটারে বসানো, দেহের বিভিন্ন উপাংশে সিগারেট ছ্যাঁকা– অত্যাচারের বিভিন্ন কান্ড কারখানা প্রদর্শন করে আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেছিল সিদ্ধার্থের পুলিশ।
এনকাউন্টারের নামে এক নারকীয় উল্লাসের আবিষ্কার করেন তারা।সারা ভারত জুড়ে রেল ধর্মঘট। কাঁচরাপাড়া রেল কলোনি সন্ত্রস্ত, ডাঙ্গাপাড়া, ফোরম্যান কলোনি থেকে রেলকর্মীরা পাড়াছাড়া। মস্তান বাহিনী প্রদর্শন করলো দানবিক চেহারা। কারা সেদিন দাপিয়েছিল রেল কলোনিতে? রেল কর্মচারীর মা বোন স্ত্রীর ওপর পাশব অত্যাচার চালানো হয়েছিল কার মদতে? নিশ্চয়ই সিদ্ধার্থ শঙ্কর। সেই সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় চলে গিয়েছেন ৬ই নভেম্বর ২০১০। আজ ২০ অক্টোবর ২০১৯, তার জন্ম শতবর্ষ।
আসুন একটু পিছনে ফিরে যাই। শাসন ক্ষমতার ভার হাতে নিয়ে দিল্লি থেকে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেন সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় ৫ জুলাই ১৯৭১। হাওড়া ব্রিজের ওপর খোলা জিপে তিনি। গায়ে লাল রঙের ব্যানলনের গেঞ্জি। লাল রঙের গেঞ্জির কি কোনো প্রতীকী ব্যঞ্জনা ছিল?
৭৩ থেকে ৭৫ সালের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে দু হাজারেরও বেশি ছেলেকে নকশাল বলে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে আশিজনকে হত্যা করা হয়েছে জেলে।
হায়নার রাত। ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ পুলিশের গুলিতে পাঁচটি যুবক টাল খেয়ে পড়ে গেলো পূর্ব বেলেঘাটায়। ডায়মন্ড হারবার–২৬ জানুয়ারি ‘৭১। হায়, প্রজাতন্ত্র! গাঙ্গেয় উপকূলে বালি মেখে শুয়েছিল ৬টি লাশ। দুজনার বুকে, একজনের পেটে আর তিনজনের পিঠে ছিল গুলির দাগ। স্মৃতির দেয়ালে কোন্নগর, দমদম, হাতুড়ি মারছে। ১ জুন ‘৭১। মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেলো ন’টি মৃতদেহ। মৃতদেহগুলি ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঝুলেছিল।
কবি কি মরে? লেখক কি মরে? লেখক কি মরেও লেখে? সাংবাদিক নিজেই কি সংবাদ হতে পারে? পুলিশ সরোজ দত্তকে ৪ আগস্ট ‘৭১ গুলি করে মারে ময়দানে। এতটুকু লাশের জন্য এতবড় ময়দান প্রয়োজন! হাপিস হয়ে পারাপারে চলে যায় তার দেহ।
খুব মনে পড়ে বরানগর- কাশীপুর তোমাকে। দুদিন ধরে মনে পড়ে। বারো থেকে তেরো আগস্ট ১৯৭১। মনে পড়ে বরানগর -কাশিপুরের ঘটনা? জালিয়ানওয়ালাবাগের নিপুণ জল্লাদ জেনারেল ডায়ারকেও পরাস্ত করেছিল। ফ্রন্টিয়ারের হিসাব অনুযায়ী ১৫০ জনের ওপর তরুণ কিশোরকে হত্যা করা হয়েছিল। আর ভাগীরথীর জল তুমি কত লাল হয়েছিলে! ২৮ জুলাই ‘৭২ proclaimed অফেন্ডার বলে ঘোষিত রাজনৈতিক নেতাকে হত্যা করা হল। যার মাথার জন্য দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষিত হয়েছিল সেইসময়। সেই চারু মজুমদারকে হত্যা করা হল। এই ছিল সিদ্ধার্থ রায়ের জমানা।
আমরা স্লোগান তুলেছিলাম– “বদল দো ইয়ে জমানা”।