জাগতে রহো!
ভূমিজ কুশীলব-কারিগরদের নির্মাণ, তাজমহল দর্শনের পর

আমি কে? কেন আমি?
তমাল সাহা

ভারতবর্ষ! ইতিহাস লেখে ভারতবর্ষ সুমহান। কেউ লেখেন, বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য। কেউ লেখেন, সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ! কেউ লেখেন, ভারত তীর্থ।

লেখা তো হয় অনেক কিছুই, দেখা তো হয় বহুবিধ!পর্যবেক্ষণ কি বলে?

বিশ্বের মানচিত্রে এখনো ঝুলে আছে দক্ষিণ মহাসাগর পারে ত্রিকোণীয় পরোটার আকৃতি নিয়ে এই দেশ। এই দেশের বিপুল জলপ্রবাহে এখনো রক্তস্রোত বয়ে চলে।

তিনশ চারশ হাজার বছরের হিসেব কষে আর কি হবে? জেন্দাবেস্তা বাইবেল উপনিষদ কোরআন ত্রিপিটক গ্রন্থসাহেব কী নেই এই দেশে! নেই শুধু সম্প্রীতি–ভালোবাসা।
কত পয়গম্বর নবী সুফি সন্ত আউল বাউল তো এলো গো! শেষ পর্যন্ত পরিণতি কোনদিকে যায়?

কে আমি ? এই জিজ্ঞাসার উচ্চারণ যুগ যুগ ধরে চলতে থাকে কিন্তু কোন্ ভাষা পায়?
উচ্চারণের সঙ্গে যদি না মেলে আচরণ
তবে তো সেই ‘চরণ’ দূরে সরে যায়!

নাটক তো কঠিন নয়, সহজ কথা বলে। আর এই সহজ কথা আমরা সকলেই জানি। তবে নাটক কি কিছুই বলে না? বলে,
আরো ভাবো অনুভবে, এসেছ ভবে
বিস্তৃত করো মানবতার বাণী।

দারার উচ্চারণে ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ নেই, কাতরতা আছে, আবেদন আছে। তা তো থাকারই কথা। পৃথিবীর বাদশা শাহজাহান কেন পুত্রের নাম লিখেছিলেন দারা শিকোহ? অভিনেতার কৃতকর্মে ও সংলাপ উচ্চারণে তার নামের অর্থ প্রতীয়মান হয়ে ওঠে। জাহানারা তো জাহানারাই, সুন্দর পৃথিবী নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা যথার্থ প্রকাশ ঘটেছে তার অভিনয়ে ঔরঙ্গজেব কি মসনদের সৌন্দর্য সম্মান আনতে চেয়েছিল? আলমগীর হবে বলে কূটকৌশলীয় কথা বলতে জানে সে, আবেগে বেগ জড়িয়ে হৃদয়ের বিষাদের কথাও বলে।
কাজী বিচারের ক্রিয়া প্রক্রিয়া এ সময়কেও ধরতে চায়। দারার বিনম্র জবাবদিহি যুক্তিতে মূর্ত হয়ে ওঠে। চিকিৎসক দেশি হাকিম বা বিদেশি ডাক্তার হতে পারে কিন্তু আদালত বিচারশালা না হয়ে কোর্ট হয় কি প্রকারে? বোধ করি বহুশ্রুত চলতি কথা চলে আসে আকস্মিক বিভ্রমে।

ভারতবর্ষের প্রেক্ষাপটে নাটকটি নিশ্চিত বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ব্যঙ্গ করে শ্লেষ
ছুড়তে চায় এবং তা বোঝাও যায়। শাসনব্যবস্থা যখন মুসলমানি তখন যে বিক্রম, যখন তা হিন্দুস্তানি হয়ে ওঠে তখনও সেই একই পরাক্রম– ক্ষমতা! ক্ষমতা! এখানেই নিহিত থাকে ধ্বংসের আয়োজন।
এত ধ্বংসের ভিতরেও বেঁচে থাকে গান নয়, সংগীত। বেঁচে থাকে আমির খসরুর কাওয়ালী, সুফি কথা।

শুধু বলবার জন্যই বলা নয়, দায়সারা কথা নয়, কোনো ভণ্ডুলের বার্তা নয় নাটকটি উত্তরণে বুঝেছি দেখেছি কুশীলবদের সমবেত সক্রিয় সাড়া।

প্রেমের সমাধি তাজমহলের সামনের চত্বরে আমির খসরুর সমবেত গীতের মধ্য দিয়ে নাটকের সূচনা হলেও এই শিল্প স্থাপত্যের অন্দরে ও অন্তরে হিন্দু-মুসলমান ওস্তাগরদের হাতের নিপুণ কারিগরি শ্রম ঘাম ও রক্ত লুকিয়ে আছে তা আমার মনে পড়ে যায়।

কিছু উচ্চারিত আরবি বা উর্দু শব্দ যদিও তার উৎস জ্ঞাত নই, কিভাবে তা বিদগ্ধজনের জন্য নয়, আমার মতো সাধারণের বোধগম্য করা যায় তা ভাবনার প্রয়োজন অনুভব করি। নাটকটি সংলাপ প্রধান। উচ্চারণ বৈশিষ্ট্যে গীতিকথাগুলি আরও স্পষ্ট হলে শ্রবণের মাধ্যমে হৃদয় সুখকর হয়ে উঠবে বলে আশা রাখি। নিশ্চিত দর্শন ও প্রণিধান যোগ্য এই নাটক। ‌

এই সুমহান নক্ষত্রবীথি তলে যেদিকে তাকাই দুনিয়া জুড়ে মানুষের ভিড়
জলে স্থলে বিস্তৃত ভূমন্ডলে শুধু মানুষের তসবীর

এইখানে এইসব নদী সমুদ্র অরণ্য উপত্যকা মালভূমি পার্বত্য ঢাল সৃজন করেছে কে?
আমি তো জানি না,আল্লা বা ঈশ্বর!
যদি তাই হয় তবে, শেষ পর্যন্ত তারা সৃজন করলো কেন মানুষ—
দিক থেকে দিগন্তে শুনতে পাই তাদের কণ্ঠস্বর।
তারা বোধ করি বুঝেছিল কোথাও রয়ে গেছে শূন্যতা।
মানুষ ছাড়া কিছুই সম্পূর্ণ নয়, পায় না পরিপূর্ণতা
ব্যক্তি মানুষই কি সব? চাই আনন্দ, চাই উৎসব!
ভালোবাসাই তো আসল মানবতা।

তুমি কি চাও দারা শিকোহ,তুমি তো সবই জানো।
বিভেদের আসানে সর্বধর্ম সমন্বয় মানো।
কোরআন উপনিষদ কি বলে হে মুসাফির!
ভালোবাসা প্রতিষ্ঠা না পেলে সুর অঙ্গ নয়, অন্ধকার! ধ্বংসের সুড়ঙ্গ গভীর।

লড়েছ তুমি, লড়ে যাও তুমি।
তাজমহলের অদূরে পড়ে থাকে তোমার কবন্ধ শরীর
তুমি তো ভৌগোলিকে ঐতিহাসিক প্রবীর।
বিচ্ছেদ মানে তো বিভাজন ধর্মের দুটি খণ্ড
মসনদে হাজির পাত্রে স্থাপিত তোমার ছিন্নমুণ্ড।

বর্ণসমূহের দিকে তাকাও!
অনুস্বার হয়ে গিয়েছে রক্তপাতের প্রতীক
চন্দ্রবিন্দুতে ধরা আছে মৃত্যুর চিহ্ন
শেষ পর্যন্ত হাতে থাকে দুফোঁটা অশ্রুজল প্রতীকে বিসর্গ।
তুমি চলে যাও হে ফরিস্তা! বলে যাও
ভালোবাসার প্রকৃত উপহার আত্মোৎসর্গ!

নাটক তাজমহল রচনা হর ভট্টাচার্য
নির্দেশক সুদীপ্ত দত্ত
প্রযোজনা গয়েশপুর সংলাপ