আমিই প্রকৃত মেষপালক
তমাল সাহা
রাণাঘাটে কবিতা পাঠের আসরে আমি ছিলাম গোপালক। জীবনে কত আশ্চর্য ঘটনা ঘটে! কবিতা পাঠ থেকে ফেরার পথে সেই আমি গোপালক থেকে হয়ে গেলাম মেষপালক।
ফিরতি পথে সুশান্ত বলে, কাকু! এলেই যখন আর তোমার আফসোস বড়দিনে প্যালেস্টাইনের কবিতা পড়তে পারলে না, তাহলে চলো মেরি ক্রিসমাস উৎসব দেখে যাই। তোমাকে দেখাই শহরতলির পার্ক স্ট্রিট পাড়া।
গাজার শিশুরা এখন রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছে ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী অঞ্চলে। যিশুও তো রক্তাক্ত হয়েছিল ক্রুশবিদ্ধের কালে ফরিসি পুরোহিতদের হাতে। চলো ক্রুশবিদ্ধ যিশুকে দেখে আসি।
ন্যাশনাল হাইওয়ে নাম্বার ৩৪। রাণাঘাট খ্রিস্টান অধ্যুষিত অঞ্চল। এখানে রয়েছে বিভিন্ন খ্রিস্টান পাড়া। বোগে পাড়া, ডনবক্স পাড়া। খ্রিস্টিয় উৎসব চলছে। নব প্রজন্মের কিশোর কিশোরীদের ভিড়। আমরা ঢুকে পড়লুম সেন্ট লুক গির্জায়। সে এলাহি আনন্দমেলা। মেলা শুধু নয় সারা পাড়া আলোয় সেজেছে। রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজছে, বাজছে খ্রিস্টিয় সংগীত। গির্জাটি ১৯০১ সালে তৈরি। গির্জার চত্বরে ডালপাড়া ছড়ানো একটি বিশাল আম্রবৃক্ষ দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে যাই। বাবা আমার, তার ছিল সংস্কৃতে দখলদারিত্ব। বাবা বলেছিল, আমগাছ উচ্চারণে যে মনন তৈরি হয়, তুমি যদি সেখানে সংস্কৃত ভাষাতে আম্রবৃক্ষ বলো তবে গাছটির বিস্তৃতি বেড়ে যায়। তাই আমি আমগাছটিকে মর্যাদা দিতে এখানে আম্রবৃক্ষ শব্দটি ব্যবহার করলাম।
বোধ করি গাছটি ২০০ বছরেরও বেশী প্রাচীন। তার নিচে সাজানো যিশুর জন্মপ্রহর। দেখি খড় বিচুলি, ঘোড়া–আস্তাবল। দ্য গিফট অফ দ্য মেজাই-এর সন্তদের দেখি। শান্ত আকাশ, একটি চাঁদ, অসংখ্য নীলচে নক্ষত্র। শিশু যিশু হাত পা ছুড়ছে।
আমি চোখে দেখি ফিলিস্তিনি শিশুরা হাত পায়ে রক্ত মেখে শুয়ে আছে জাবালিয়া, মাঘাজি শরণার্থী শিবিরে।
কিছু কিশোরীর সঙ্গে দেখা হলো এই গির্জা মন্দিরে। আমি যখন প্রার্থনাগৃহে দাঁড়িয়ে দেখি, যীশু নেই এবং বন্ধু সেন্টুর সঙ্গে কথা বলি, যিশু কোথায়, এতো শুধু ক্রুশ কাঠ! সঙ্গে সঙ্গে বলি, ঠিকই আছে। ক্রুশকাঠ-ই তো এখন প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। শোষণের প্রতীক। এটাই তো বহন করেছিল যিশু। তখন একটি মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আগ বাড়িয়ে আমার কাছে এসে বলে, তুমি কি বাংলাদেশ থেকে এসেছ? আমি বলি, তুই কেন এ কথা বলছিস? ও বলে, তোমার কথায় বাংলাদেশের টান আছে। শুনতে ভালো লাগছে। আমি বলি, তুই তো খুব পাকা মেয়ে! আমাকে কি চিনিস? চিনি না তো কি? ওর বন্ধুরা বলে, ও খুব ভালো মেয়ে। এমনি করেই কথা বলে, ছোট বড় সবার সঙ্গে মিশে যেতে পারে।
এই ডিজিটাল যুগেও এইসব কিশোরীরা এভাবে বড়দের আদর স্নেহ ভালোবাসা সব অজান্তে কেড়ে নেয়!
এরপর চলে যাই আরো একটি গির্জা মন্দিরে– গোয়াডাল্যুপ মারিয়া গির্জা। সেখানেও যিশুকে দেখি। যিশুর জন্মাবার মডেল-পুতুল দৃশ্যও দেখি। এই গির্জাটি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল, এই তো সেদিন ১৯৮১ সালে।
কত দোকানপাট পসরা সাজিয়ে বসেছে। এখনকার ছেলেমেয়েরা যা যা খেতে চায় কেক, পিৎজা, মোমো, ঘুগনি ফুচকা, গরম গরম আলুফ্রাই … সব আছে।
কত ফেরিওয়ালা, ট্রাফিক পুলিশ, পথচলতি মানুষের সঙ্গে কথা বলি। তারা জানায়, নিউ ইয়ার মানে পয়লা জানুয়ারি পর্যন্ত এই মেলা চলবে।
গো-উপাখ্যানের কবিতা পাঠ, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, বড়দিনে কিশোরীদের সঙ্গে স্নেহ মাখানো কথাবার্তা এই-ই আমার ঘরোয়া জীবন। একটি দিন চলে গেল….
রামপ্রসাদের উত্তর ২৪ পরগনার রামপ্রসাদের দেশের মানুষ আমি, আজকের দিনটি কাটিয়ে দিলাম চৈতন্যের দেশ নদিয়ার রাণাঘাটে।
জীবন বয়ে চলে….
২৬ ডিসেম্বর, ২০২৩