স্বাধীনতার ৭৫ তম বর্ষঃ পর্ব ৩
অন্ধকারের মধ্য দিয়েই দেশ দেখো
তমাল সাহা
বাবা বলছে দ্রুত হাঁটো। অন্ধকারের মধ্য দিয়েই দেশ দেখো। উজ্জ্বল আলোয় ঢাকা শহর দেখেছো, রমনার ময়দান দেখেছো। দেখেছো ভাগ্যকুল রাজবাড়ি। দেখেছো পণ্যবাহী গয়না নৌকো। এখন দ্রুত হাঁটো।
ভাগ্যকুল ঘাট থেকে স্টিমারে যেতে হবে গোয়ালন্দ ঘাট।
অন্ধকারে দেশ না আমার চোখে অন্ধকার? এত মানুষ! বাবা বলে, মানুষ কোথায়?
এরা মানুষ নাকি! এদের জীবনের কোনো মূল্য আছে নাকি?
দেখেছো তো স্টিমারের ভিড়– ঠেলাঠেলি, হুটোপুটি।
এবার চলো ট্রেন ধরতে হবে।
রামপ্রসাদী সংগীতের কথা মনে কর, মা আমায় ঘুরাবি কত কলুর চোখ ঢাকা বলদের মতো!
লালনের গানের কথা তোমার মনে পড়ে? খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়! খাঁচা হল তোমার পৃথিবী। অচিন পাখি হল আমরা এই অচেনা অজানা মানুষজন।
ট্রেনের বগিতে ছাদে এসব কি কোনো মানুষ? এরা কেউ মানুষ নয়, শরণার্থী–নতুন ভাষা। আমরা এখন সবাই এক। দেখো সবার চোখে মুখে কত মিল, সবার মুখ শুকনো, চোখে আতঙ্কের ছাপ। এইসব হচ্ছে দেশের মনিষজন। দেশ থেকে দেশান্তরে পালানোর মানুষ। পালানো, পালানো ছাড়া কোনো গতি নেই। তুমি কোথায় পালাচ্ছো, কেন পালাচ্ছ, পালানোর পর কি করবে কিছুই জানো না। তবুও তুমি পালাচ্ছো। আমরা এখন দেশ থেকে দেশান্তরে পালানোর মানুষ। আমরাও পলাতক আমাদের এখন কোনো সাকিন নেই। ওই যে সব লোকগীতি, লোকশিল্পীর গান!বাউল, ভাটিয়ালি সারিজারি ময়মনসিংহ গীতিকা– যতই তুমি গাও, গানে কি অস্তিত্বের সংকট মেটে? অস্তিত্বই যখন সংকটে তোমার গলা দিয়ে কোন গান বেরুবে?
অসম্ভব গাদাগাদি চাপাচাপি অবস্থায় গোয়ালন্দ থেকে ট্রেনে আমরা উঠলাম। তারপর ঘেমে নেয়ে একসা। দম বন্ধ হয়ে যায়। আমরা পৌঁছালাম রানাঘাট।
এটা কি স্টেশন! প্লাটফর্ম! শুধু হতচ্ছন্ন মানুষ আর মানুষ। বাবা বলে, একে বলে মধ্যরাতের স্বাধীনতা। স্বাধীনতা মানে স্বস্তি, মুক্তি। তাই কি তোর মনে হচ্ছে এতো হুড়োহুড়ি? কেউ জানেনা। বাবা বলে এর মধ্যেই সব শিখে নিতে হবে।
ওদিকে লাইন ধারজুড়ে এঁটো শালপাতা ছড়ানো। খিচুড়ির এঁটোকাটা। বাবা বলে এটা স্বাধীনতার খিচুড়ি। একটু দূরে ছাউনি। বাবা, ওটা কি? ওটা লঙ্গরখানা। চুলার পর চুলা জ্বলছে। কাঠের চুলা। কড়াইয়ের পর কড়াই এই গরম ঝলঝলে খিচুড়ি। স্বাধীনতার খিচুড়ি, স্বাধীন মানুষ খাবে। বাবা, আমরা এখান থেকে কোথায় যাবো? আমরা কাঁচরাপাড়া যাবো। তোমার কাকারা আসবে। আমাদের মতো উদ্বাস্তুদের রিসিভ করবেন,স্বাধীন ছিন্নমূলদের স্বাগত জানাবেন। বাবা, ওই যে বিশাল বিশাল ত্রিপলের ছাউনি,গালে হাত দিয়ে ছেলে বুড়ো সব বসে আছে। ক্লান্ত অবসন্ন, কেউ শুয়ে পড়েছে….।একে বলে ত্রাণ শিবির রিলিফ ক্যাম্প। বাবা, ওরা বলছে, ওরা চাঁদমারি কলোনি চলে যাবে। কেউ বলছে শহীদনগর কলোনি, কেউ বলছে ক্ষুদিরাম কলোনি। বাবা কলোনি কি? কলোনি তো উপনিবেশ। এগুলো উদ্বাস্তুদের অস্থায়ী ঠিকানা।
দেশ স্বাধীন হলো। তমু নিজের চোখে দেখল লঙ্গরখানা, ত্রাণ শিবির। ইংরেজিও শিখলো রিলিফ ক্যাম্প। কলোনি। এঁটো শালপাতা।কত সব শব্দ তার বাবা তাকে হাতে ধরে শেখালো।
স্বাধীনতা তুমি কত নতুন শব্দ নিয়ে এসেছ আমাদের শেখাবে, উপহার দেবে!