বাংলা মদের আড্ডার আলোচনাঃ যে দুই কবি প্রচুর মদ খেতেন তাদের দুজনেরই আজ জন্মদিন

মদের মত কবিতা
তমাল সাহা

মধ্যবিত্তের মদ খাওয়া নিয়ে বেশ অসুবিধে আছে। বেশিরভাগ যারা এই মধ্যবিত্ত বাড়ির, সেই বাড়ির মেয়েরা তো মদ খাওয়া খুব একটা পছন্দ করেনা। তবে এখন আর সেই সাবেকি ধ্যানধারণা অনেক কমে গেছে বলেই মনে হয়। আর মধ্যবিত্ত শব্দটা আমার কাছে খুবই গোলমেলে।

অ্যালকোহল কনজামপশন ইজ ইনজুরিয়াস টু হেল্থ– এই সরকারি বিজ্ঞাপনের আগেই আমরা জানতাম মদ খাওয়া খারাপ। আমি এক মদের আড্ডায় বলেছিলাম, যিনি মদ আবিষ্কার করেছিলেন কেন তাকে নোবেল দেওয়া হয়নি ?আমরা মদ্যপ্রেমীরা এই নিয়ে অভিযোগ জানাতে পারি।

তা যাই হোক, মদ খাওয়াতে সাপোর্ট পাবার জন্য আমরা খুঁজে বার করতাম কে কে মদ খেতেন! রবীন্দ্রনাথ খেতেন কি? রবীন্দ্রনাথ খেলেই আমাদের সব দোষ ধোয়া তুলসী পাতা। একজন বলল, আমি পড়েছি, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত মদ খেতেন। আমি বলি কোনো মেয়ে খেয়েছে এমন উদাহরণ আছে? নটী বিনোদিনী খেতেন? সে বলল, তা জানিনা। তবে সে সময়ের গণিকারা খেতেন। আমার বাড়ির মহিলাকে এ যুক্তিতে কোনোমতেই পক্ষে আনা যাবে না। আমি তাকে কত করে বোঝাই…
তবে শোনো কমলকুমার মজুমদার, সমরেশ বসু, শক্তি সুনীল সবাই খেতেন। আমি বলি, সত্যজিৎ, মৃণাল খেতেন।
আমার ঘরের লোক একটা গালে চড় কষা জব্বর জবাব দেয়। তুমি কি রবীন্দ্রনাথ, সুনীল, শক্তি, ঋত্বিক, রামকিঙ্কর?
আমি বলি, হতেও তো পারি!
সে বলে, তার যখন হবে তখন
খেও।

হৃষীদা বলে, থাক!ছেড়ে দে। ঋত্বিক রামকিঙ্কর যে খেতেন তা সকলই জানে। ঠিক আছে, আমারটায় ঢাল্! একটু জল কম দিবি। ওই যে বারুদ বালিকা কমিউনিস্ট কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত খেতো বা তারাপদ রায়? আমি বলি, তারাপদ রায় নিশ্চিত খেতো। না হলে এতো জলের মতো কবিতা লিখতে পারত না। আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে বলতে পারতো না। দশ তলা, আট তলা, না ন তলা, সেসব ফ্ল্যাটের ভিতরে নাকি সমুদ্র ঢুকে গেছে!

সুধাদা বলে মদই জীবন। ওই বার- ফার আমার ভালো লাগে না। মদের কোন ঋতু সময় নেই। ঝড় জল বৃষ্টি রৌদ্রপাত জ্যোৎস্না সকাল বিকেল দুপুর সন্ধ্যে অথবা বস্তি মহল্লা, ইটভাটা, লাল মাটির জমি শিমুল পলাশ গাছ ধুমল পাহাড় নদীর পার–স্থান ও সময় ভেদে মদের স্বাদই আলাদা। কাঁচা নুন আদার টুকরো বা দোভাজা ফাটা ফুলুরি দিয়ে বাংলা মদ খাওয়া একটা ধ্রুপদী ব্যাপার। বারদুয়ারি, খালাসিটোলা বৈঠকখানার ভিতরে মদের ঠেকের ঘ্রাণই আলাদা।
জানিস তো আমি ভদ্রলোকদের সঙ্গে মদ খাই না। মদ খেলে তো জ্ঞানের ভাণ্ডার খুলে যায়, আমি পড়াশোনায় কমজোরি। আমার অত জ্ঞানট্যান ভালো লাগে না।
শ্রমিক নিরক্ষর তাই কি তুমি তাকে বুঝাচ্ছো শ্রম কি? মানবজমিন যে চাষ করছে তাকে শেখাচ্ছ প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও কষ্টের কথা! যে তোমাকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, দরদর করে ঘামছে সেই রিকশাওয়ালাকে তুমি বলছো শোষণের কথা! যে মেথর ওর সকাল থেকে সাফাইয়ে নেমেছে তাকে কি বোঝাবে তুমি?
এই শালা, চল আদি সপ্তগ্রাম যেখানে আমবাগানে ওরা চোলাই বানায় সেখানে। ওরা পাতন প্রক্রিয়া জানে, নিশাদল ইউরিয়া চেনে ওদের বলছো প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস করবি? চল্ ওখানে গিয়ে গরম চোলাই খাই। গিয়েছিস কোনোদিন শিমুলতলায়? আদিবাসী মেয়েটার হাতে বানানো গরম মহুয়া শালপাতায় করে খেয়েছিস কোনোদিন? কিছুই তো দেখলি না, শিখলি না! আকাশে তখন ঝুলছে দড়ি পেঁচিয়ে বাঁধা বোমের মতো চাঁদ।

হৃষীদা বলে, যেদিন মধ্যরাতে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হলো সেদিন নেহেরু জিন্না ও প্যাটেলকে মাউন্টব্যাটেন মদ খাইয়ে নিয়েছিল। নেহেরুকে বেশি দামি, জিন্নাকে একটু কম দামের মদ আর প্যাটেলকে মদ খাইয়ে বেহুশ করে ফেলেছিল। নেহেরুকে ভালোবাসতো মাউন্টব্যাটেন। দুখণ্ড হয়ে গেল দেশ। মদখোর স্বাধীনতা!
ওই দেখ স্বাধীনতার নাকি ৭৫ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। এখনো টালমাটাল পায়ে হাঁটছে স্বাধীনতা। ওর লিভারে পচন ধরেছে বুঝি!

অদ্য মদ্য পদ্য
তমাল সাহা

শক্তি ও অমিতাভ ছিল দুই বন্ধু গলায় গলায় ভাব
দুজনার কবিতাতেই ছিল শাব্দিক রোয়াব

দুজনেই একসাথে মিলে খেত মদ্য
দুজনেই লিখতো মানুষের জন্য পদ্য

দুজনেরই জন্মদিন অদ্য!